সন্ধ্যে প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘরের অন্ধকার দূর করল মেয়েটি। ছোট্ট একটা ঘরে একাই থাকে সে – একার সংসার। দিনের বেলায় যেদিন যেরকম কাজ জোটে, সেরকমই কাজ করে দিন চালিয়ে নেয় সে। আর সন্ধ্যের পর রান্না চড়ায়। আজও সেই কাজেই যাবে যখন, হঠাৎ-ই দরজায় টোকা।
“কে?”
“আমি পথিক।“
বেশ বড়ো করে ঘোমটা টেনে দরজাটা একটু ফাঁকা করল মেয়েটি। বাইরে একজন শহুরে বাবু দাঁড়িয়ে আছেন।
“আমি কলকাতা থেকে এসেছি। ট্রেন লেট ছিল সাড়ে তিন ঘণ্টা। বাড়ি আমার শীতলপুর গ্রামে। আজ ওপথে এগোনোটা কঠিন। আপনার বাড়িতে রাতটুকু শুধু ঠাঁই দিলে বড় উপকার হতো।“
মেয়েটি কয়েক মুহূর্ত ভাবল। তারপর বলল,”আসুন“। প্রদীপের আলোতে খুব একটা ভালো করে দেখতে পেল না পথিক। আস্তে আস্তে চোখ সয়ে যেতে লাগল তার। খাটের এক পাশে বসল সে। খাট ছাড়া বসবার আর কোনো জায়গা নেই। এক গ্লাস জল এগিয়ে দিল মেয়েটি। এবার পথিক তার মুখ দেখতে পেল।
“আর কিছু নেই আমার কাছে।“
“এই যথেষ্ট। বড় তেষ্টা পেয়েছিল।“
“রাতে আপনার পাতে ঘি দিতে পারব না। সামান্য কিছু তরি-তরকারি আছে শুধু। আজ রাতটুকু চালিয়ে নিতে পারবেন কি?”
“ভগবানের অসীম কৃপা যে আমায় আপনার খোঁজ দিয়ে দিয়েছেন। নইলে যে উপোস রাখতে হতো আজ। এই পাঁড়াগাঁয়ে শুনলাম কাছাকাছির মধ্যে হোটেল নেই কোনো। আমার তো আপনার প্রসাদে চলে যাবে। তবে আমি এসে আপনার বড় ক্ষতি করে দিলাম বলুন? “
“দরিদ্র আমি। তবু জানি অতিথি নারায়ণ। ভগবানকে যে এই অভাগী দু’টো রেঁধে খাওয়াতে পারবে, তাই যে সৌভাগ্য!”
“ছিঃ! ছিঃ! ভগবানের সাথে তুলনা করে এই নরাধমকে ছোট করবেন না! আর কাউকে দেখছি না যে?”
“আমার আর কেউ নেই। একাই থাকি, একাই দু’টো ফুটিয়ে খাই। দিব্যি চলে যায় দিন।“
“ভয় করে না আপনার একা থাকতে?”
(কয়েক মুহূর্ত চুপ)”সময় যায়। রান্না চড়াতে হবে। আপনি বিশ্রাম নিন বরং।“
“কী নামে ডাকব আপনাকে?”
“এ গ্রামের সবাই বিধবাবৌ বলে ডাকে আমায়।“
“সে তো গ্রামের লোক। আমি তো পথিক। একদিনের অতিথি আপনার। আমার আপনাকে ঐ নামে ডাকতে ভালো লাগবে না।“
“চঞ্চলা।“
পথিক গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ঘুম এসেও যেন আসছে না। কানে আসছে রান্নাঘর থেকে বাসনপত্রের ঠুংঠাং শব্দ। পথিকের মনে হলো মাথার ভেতরটা কেউ যেন ঘেঁটে দিলো।
“শুনছেন? ঘুমিয়ে পড়লেন কি?”
“হু?”
“রান্না হয়ে গেছে। খেয়ে নেবেন চলুন।“
“দাঁড়ান। হাতমুখ ধুয়ে আসছি।“
পরম যত্নে থালায় ভাত সাজিয়ে দিল মেয়েটি। আড়ম্বর নেই, তবে আবেগ আছে। অনেকদিন পর কারোর জন্যে থালা সাজিয়ে অপেক্ষায় আছে সে। পথিক এসে খাবার মুখে দিয়েই বলল,”আরে! করেছেন কী বলুন তো! আমাকে সুস্বাদু খাদ্যের লোভ ত্যাগ করতে বলে রাজ অন্ন এনে দিলেন?! এ কেমন বিচার আপনার?”
“আমার পেটে অত বিদ্যে নেই। তাই বুঝি না। এ তিরস্কার না পুরস্কার?”
“এ এই অভাগার কৃতজ্ঞতা। স্বীকার করবেন তো?”
“পথিক, দোহাই আপনার। আর কথা বাড়াবেন না। যদি খুব অখাদ্যও রেঁধে থাকি, তবুও দয়া করে মুখে তুলুন। আমার আত্মার শান্তি হোক।“
“এ কি অনুরোধের পেছনে লুকিয়ে আদেশ?“
“আমি আর কিচ্ছুটি জানি না। আপনার খাওয়া না হওয়া অবধি আমি আর কথা বলব না।“
পথিক হাসল। খাওয়ার সময় আর কোন কথা হল না দু’জনের। খাওয়া শেষে চঞ্চলা পথিকের শয্যা তৈরি করতে লাগল।
“চঞ্চলা!”
“আজ্ঞা করুন।“
“একটি মাত্র বিছানা আপনার ঘরে। এখানে আমার জায়গা হলে গৃহীর কী উপায়?”
“গৃহ যখন গৃহীর, তখন উপায় সে বের করেই নেবে পথিক। কিন্তু অতিথির সেবায় ছাড় দিলে যে গৃহীর আত্মতৃপ্তি হবে না।“
“আর এরূপ আচরণে অতিথির যদি নিজেকে দোষী মনে হয়?”
“গৃহীর অনুরোধ সে যেন নিজেকে এবং গৃহীকে উভয়কেই ক্ষমা করে দেয়। শয্যা তৈরি। শুয়ে পড়ুন। রাত অনেক হয়েছে।“
চঞ্চলা রান্নাঘরে শুতে গেল। রান্নাঘরের খিল আটকে দিল সে। মাথার নিচে হাত রেখে মাটিকে আলিঙ্গন করে শুয়ে পড়ল। নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। পাছে তার কান্নার শব্দে পথিকের ঘুম ভেঙ্গে যায়। জীবনে তার পুরুষ আসে- খণ্ড চরিত্রের মতন। সময় দেয় না বেশিক্ষণ। কোন পুরুষই তাকে আঁকড়ে ধরে না কেন?কেন সবাই একা ফেলে পালিয়ে যায়? তারও তো ইচ্ছে করে পুরুষ আঁকড়ে বাঁচতে!
ভোররাতে বাইরের দরজা খোলার শব্দ পেল চঞ্চলা। তাহলে কি পথিক চলে যাচ্ছে? ধড়মড় করে উঠে পাশের ঘরে গেল সে। পথিক শয্যা ছেড়েছে। খোলা দরজা দিয়ে চঞ্চলা দেখল পথিক চলে যাচ্ছে। এক ছুটে সে দৌড়ে গিয়ে পথিকের হাত চেপে ধরল।
“সেদিনের মত আবার পালিয়ে যাচ্ছ জয়ন্তদা?”
“নয়ন, আমি আর পারছি না অভিনয় করতে। আমায় ছুটি দে তুই।“
“বেশ, দেবো ছুটি। তবে আমায় তুমি বলে যাও কেন চলে গেছিলে সেদিন? কতবার করে বললাম বাড়িতে বিয়ে ঠিক করেছে আমার। চলো পালিয়ে যাই। কেন শুনলে না আমায়?”
“তোর ভালো জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আমার তো পড়াই শেষ হয়নি তখনও। কোথায় যাব পালিয়ে! খেতে দেবো কী তোকে! আমি তোকে ভালো থাকতে দেখতে চেয়েছিলাম। বড় ঘরে বিয়ে হলে তুই ভালো থাকতিস।“
“কত ভালো আছি সে তো তুমি দেখতেই পেলে বলো? বিয়ের দু’সপ্তাহের মধ্যে তিনি চলে গেলেন। শ্বশুড়বাড়ির লোক আমায় অপয়া বলে তাড়িয়ে দিল। বাপের বাড়ি থেকেও নিল না আমায়। তোমার সাথে গেলে কি আরও খারাপ থাকতাম? না কি তুমি নিজে খারাপ থাকার ভয়ে আমায় নিলে না?”
(চুপ)
“ভালবাসতে না আমায় বলো কোনদিন? সেই লুকিয়ে লুকিয়ে পুকুরঘাটে আসা শুধু তোমার পড়ার ফাঁকের বিনোদন ছিল বলো? ব্যবহার করেছ আমায় তুমি?”
“ক্ষমা করিস আমায় নয়ন। আমি যে এতটা খারাপ, তা আগে জানলে তোর কাছে কোনদিন আসতাম না। তুই যে বড় পবিত্র!”
“আমার পবিত্রতা ঘুচাও তুমি জয়ন্তদা! রাধার মত কলঙ্কিনী করো আমায়। তাতেও যে সুখ!”
“আলো ফুটতে শুরু করেছে নয়ন। আমায় যেতে হবে।“
“তোমরা পুরুষ এমন কেন? পালিয়ে যাও সবসময়! ভালবাসার কাঙাল আমি। একটু ভালবাসতে কি সত্যিই পারো না?”
“ভুল করেছিস তুই নয়ন আমায় ভালবেসে। আমি প্রতারক। প্রতারক কখনো কাউকে ভালবাসে না। আমি চললাম। ভাল থাকিস।“
“প্রতারক, তোমার প্রতারণাও যে আমি ভালবাসি। তবু তুমি ফিরে এসো, ফিরে এসো।“
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে মাটিতে বসে পড়ল নয়নতারা। নয়নের কপোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরতে লাগল। তার মনে পড়ে গেল বিয়ের আগে জয়ন্তর সাথে শেষ দেখার কথা। জয়ন্ত তাকে বলেছিল আর কোনদিন যদি তাদের দেখা হয়, তবে যেন নয়ন তাকে এড়িয়ে যায়। এতক্ষণ ধরে সেকথা পালন করে আসলেও আর পারল না নয়ন। ধৈর্যের বাঁধ গেল ভেঙে। তাই এই সমাজের বিপক্ষে গিয়ে ছুটে চলে আসা।
দ্রুত পায়ে চলতে চলতে নয়নের আর্দ্র প্রলাপ শুনতে পেল জয়ন্ত। তার মন চাইল গণ্ডূষ ভরে সে সেই জল পান করে। নয়নকে জড়িয়ে ধরে বলে,”ধুর পাগলি! তোর জয়ন্তদা আজও শুধু তোকেই ভালবাসে।“কিন্তু পারল না। কলকাতায় যে তার সাজানো সংসার রয়েছে। অতীতে ফিরে তাকালে চলবে না। তাই সময়ের কুটিল হাসির সামনে নিরুপায় হয়ে মাথা নত করে রইল সে।
লেখায় : অবন্তী
এডিট : সৌভিক